ডেক্স রিপোর্টঃ চলতি বছরের দুর্গা পুজার ছুটির সময় ঢাকা যেন এক নতুন রুপ ধারণ করেছিল। প্রতিদিন শহরের রাস্তায় যে চিরচেনা যানজট, সেটি যেন প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ব্যাস্ততম রাস্তাও যেন ছিল অনেকটা ফাঁকা।
তবে কর্মদিবসে রাজধানীর সেই একই রাস্তাগুলো যেন যাত্রীদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের যাত্রায় পরিণত হয়। ঠিক তেমনি একটি ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের রাস্তা। এখানে সকাল-দুপুর যেন এক গাড়ি আরেক গাড়ির বাম্পার থেকে বাম্পার ঘেঁষে ধীরে চলাচল করতে থাকে। কেননা এখানকার উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রায় শিক্ষার্থীই নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে স্কুল-কলেজে যেতে পছন্দ করে।
এতে করে যানজটের অবস্থা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, উদাহরণস্বরূপ ধানমন্ডি এলাকার ঐ যানজটের রেশ যেন তখন শহরের অন্যতম সড়ক মিরপুর রোডেও ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে রাস্তায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যদি না থাকতো, তবে যাত্রীরা হয়তো কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারতো।
তবে স্কুল তো আর সবসময় বন্ধ থাকবে না। এক্ষেত্রে যানজট মোকাবেলার একটি যুক্তিসঙ্গত উপায় হিসাবে স্কুল বাসের ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্কুলে যাতায়াত যেভাবে যানজট তৈরি করে
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর যানজটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের কারণ স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার।
সরকারি ডকুমেন্ট, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ও রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন শুধু ঢাকাতেই যানবাহনের প্রায় দুই কোটি ট্রিপ হয়। এই ট্রিপগুলোর মধ্যে রয়েছে স্কুল, অফিস, হাসপাতাল কিংবা ব্যবসায়িক কাজে যাতায়াত।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর হাদিউজ্জামান বলেন, “ঢাকায় মোট ট্রিপের ১৭-১৮ শতাংশই স্কুল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত সংক্রান্ত।”
হাদিউজ্জামান মনে করেন, স্কুলে যাতায়াতের জন্য যে ট্রিপগুলো রয়েছে সেগুলো শহরের মিরপুর রোড, এয়ারপোর্ট রোড ও প্রগতি সরণির মতো প্রধান সড়কে যানজটের সৃষ্টি করছে।
উদ্যোগ গ্রহণ ও ব্যর্থ
২০০৯ সালে সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলগামী যানবাহনের পরিমাণ কমাতে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তারই অংশ হিসেবে যাত্রা শুরু হয় স্কুল বাসের।
২০০৯ সালে নভেম্বর মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কর্তৃপক্ষ একটি বৈঠক করে। এতে উভয় পক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য বাস পরিষেবা চালু করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু এই ধারণাটি পরবর্তীতে আর তেমনভাবে কার্যকর হয়নি।
এ সম্পর্কে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, ব্যক্তিগত যানবাহনের কারণে সৃষ্ট যানজট নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে তিনি স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন। এতে স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ও অভিভাবকদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্কুলগুলি যদি শিক্ষার্থী পরিবহণে নিজস্ব বাস কেনে তবে আরও একটি সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেননা তখন তারা রাস্তায় বাস পার্ক করবে এবং আরও যানজট তৈরি করবে। বাসগুলো তারা সারাদিন বাস কোথায় পার্ক করবে?”
তখন নুরুল ইসলাম নাহিদ একটি নতুন পরিকল্পনা করেন। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিসি) এর সাথে কথা বলে এমন বাস সুবিধা চালু করতে বলেন যেটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্টপেজ থেকে তুলবে ও নামিয়ে দেবে। আর স্কুল চলাকালীন সময়ে বাসগুলো সাধারণ যাত্রীও পরিবহণ করবে।
তবে নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, তখন অভিভাবকেরা এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। কেননা তারা নিজেদের সন্তানদের ব্যক্তিগত গাড়িতেই যাতায়াত করাতে চায়।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার জানান, তিনি দায়িত্বরত অবস্থায় স্কুল বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কিছু অভিভাবক তাতে আগ্রহ দেখায়নি।
স্কুলটিতে সবমিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। এর শুধু বেইলি রোড ব্রাঞ্চেই রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
কামরুন নাহার বলেন, “মুষ্টিমেয় কিছু অভিভাবক চান না যে স্কুলে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে বাসের ব্যবহার শুরু করুক।” স্কুল বাসের উদ্যোগ চালু হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উপকৃত হবে বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরেও রয়েছে বহু স্কুল; যা এলাকাটিতে যানজট তৈরির অন্যতম কারণ। এলাকাটিতে অবস্থিত গ্রীণহেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ও রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজে রয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ট্রাফিক পুলিশের তথ্যমতে, এই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী যাতায়াতের জন্য তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান বলেন, “সকালে ধানমন্ডি পর্যন্ত যানজট লেগে যায়। তখন যানজটের কারণে মিরপুর রোডের যানবাহনগুলো বেশ ঝামেলায় পড়ে।”
অন্যদিকে, বীর উত্তম জিয়াউর রহমান রোডের পাশেই রয়েছে বিএএফ শাহীন স্কুল। তবে সেখানে নেই শিক্ষার্থীদের গাড়ি পার্ক করার সুবিধা। ফলে শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ গাড়িই রাস্তায় পার্ক করে রাখা হয়। অন্যদিকে ফার্মগেইটে হলি ক্রস গার্লস হাই স্কুল ও সরকারী বিজ্ঞান কলেজের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়। আর বেইলি রোড, অফিসার্স ক্লাব ও মগবাগার এরিয়ায় ভিকারুননিসা স্কুলের জন্যও একই সমস্যা দেখা দেয়।
বিআরটিসির উদ্যোগ এবং ফলাফল
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বিআরটিসির পক্ষ থেকে রাজধানীর পল্লবী থেকে আজিমপুর রুটে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু করে। প্রথম পর্যায়ে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ১৪ টি বাস নিয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
বিআরটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর (অব) এমএম ইকবাল বলেছিলেন, “এটা মাত্র শুরু। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে তবে আরও ১০০ টি বাস এই কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে।”
বর্তমান বিআরটিসি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ঢাকায় তাদের মাত্র তিনটি স্কুলবাস চালু রয়েছে। আরও ছয়টি স্কুলবাস চালু ছিল যা ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
তাজুল ইসলাম বলেন, কেন এই তিনটি স্কুল বাসও এখন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, বর্তমান স্কুল বাসের রুটের মধ্যে রয়েছে কল্যাণপুর থেকে আজিমপুর, বিমানবন্দর থেকে এমইএস হয়ে রমিজ উদ্দিন স্কুল এবং একটি মোহাম্মদপুর বাস ডিপো থেকে ছাড়ে। তবে মোহাম্মদপুর বাস ডিপোর ম্যানেজার জানান, ২০২০ সাল থেকে স্কুল বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
তাজুল ইসলাম জানান, কিছু নতুন বাস আগামী বছর বিআরটিসিতে যুক্ত হবে। সেক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বাস নতুন করে দেওয়া যেতে পারে। একইসাথে চট্টগ্রামে বর্তমানে বিআরটিসির ১০ টি স্কুল বাস চলছে বলে জানান তিনি।
২০১০ সালের ১১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুলের জন্য বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করার তাগিদ দেন। ২০১৫ সালে যানজট কমাতে ফের স্কুল বাস চালুর নির্দেশ দেন। কিন্তু এ ধরণের উদ্যোগ এখনো কার্যকর হয়নি।
তৎকালীন সময়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বিআরটিসি বাসগুলো যদি প্রতিদিন শহরের চারপাশে চলাচল করে এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল-কলেজ থেকে যাত্রী নিয়ে যায়, তাহলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করবেন না।”
২০২২ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে চারটি ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের জন্য শিক্ষার্থীদের বাসের একটি পরিষেবা চালু করেন।
ঐ সময়ে এক সেমিনারে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা দেখি অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছেন, যা রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্কুল বাস সার্ভিস যানজট কমানোর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণেও সাহায্য করবে।”
মেয়র আরও বলেন,” স্কুল বাস চালু হলে প্রাইভেট কারের ব্যবহার অনেক কমে যাবে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী স্কুল বাসে যাতায়াত করবে, তারা বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। আমাদের সামাজিক বন্ধন মজবুত হবে।”
সেবাটি চলতি বছরের মে মাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কিন্তু এখনো শুরু করা হয়নি।
সমাধান কী?
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হাদিউজ্জামান বলেন, “শুধু স্কুল বাসের উদ্যোগ ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে কাজ করবে না। কেননা রাজধানীতে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম নেই।”
এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ আশেপাশের স্কুল বা কলেজে পড়াশুনা করা। তবে সেক্ষেত্রে সরকারকে প্রতিটি এলাকায় শিক্ষার মান বাড়াতে কাজ করতে হবে।
হাদিউজ্জামান বলেন, “আপনি যদি উত্তরার বাসিন্দা হন তবে আপনাকে উত্তরার একটি স্কুল বা কলেজে পড়তে হবে। কেবল তখনই স্কুল বাস সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়া করতে পারবে।”
হাদিউজ্জামান মনে করেন, “সরকারকে প্রথমে প্রতিটি অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। আর এই অঞ্চলভিত্তিক স্কুল হতে হবে এক কিলোমিটারের মধ্যে। ঢাকা শহরের মাত্র ১০টি স্কুল কেন সেরা হবে?”
সেক্ষেত্রে দুটি পলিসি গ্রহণ করতে হবে। একটি হচ্ছে, সকল স্কুলে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, শুধুমাত্র নিজের অঞ্চলভিত্তিক স্কুলগুলিতেই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা।
হাদিউজ্জামান বলেন, “আপনি যদি অঞ্চলভিত্তিক স্কুলিং সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে না পারেন, তবে আপনি বাস সরবরাহ করে যানজট মোকাবেলা করতে পারবেন না। আপনি কী জানেন সেক্ষেত্রে কত বাস লাগবে?”
সুত্র ও ছবিঃ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড