অনলাইন ডেক্সঃ রাস্তায় বেরোলেই ‘সাধারণ পরিবহন’, ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’ লেখা ট্রাক চোখে পড়ে হরহামেশা; এমন ট্রাক দেখতেই দেখতেই বুড়ো হওয়ার পথে একটি প্রজন্ম। তবে সেই বেডফোর্ড ট্রাকগুলোর জীবনকাল যেন ফুরাতেই চাইছে না!
বিশ্বের অনেক দেশে এই ট্রাক জাদুঘরে চলে গেলেও বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাজার দশেক বেডফোর্ড। গাড়ির রূপ আর রঙ রয়ে গেছে প্রায় আগের মতই। তবে পুরনো ইঞ্জিনে এখন রসদ যোগাচ্ছে ‘সিএনজি’। দেশে চলাচলকারী বেশিরভাগ বেডফোর্ড ট্রাকের বয়স ৪০ বছরের উপরে। কোনো কোনটার বয়স ৬০ বছর হলেও চলা থামেনি।
ট্রাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটা সময় ডিজেল খরচে ভারতীয় কোম্পানির ট্রাকের সঙ্গে পেরে উঠছিল না বেডফোর্ড। তবে সিএনজিতে গাড়ি চালানোর সুযোগ আসার পর বেডফোর্ড পেয়েছে নতুন জীবন। এখনও ঢাকার নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে এই বেডফোর্ডই ভরসা।
ইংল্যান্ডের ভক্সহল মোটরস ১৯৫৮ সালে বেডফোর্ড টিজে মডেলের ট্রাক উৎপাদন শুরু করে, যা ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। আর ১৯৫৯ সালে শুরু হয় বেডফোর্ড টিকে মডেলের উৎপাদন, সেটিরও উৎপাদন ৯০ দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই মডেলটি এমকে বা মিলিটারি মডেল হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়।
পরে অবশ্য বেডফোর্ড টিজে ট্রাক উৎপাদনের স্বত্ব পায় এডব্লিউডি, যারা নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত উৎপাদন চালু রাখে। বেডফোর্ডের এই দুটো মডেলই বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
বেডফোর্ড ‘টিকে’ মডেলের ট্রাকগুলো ‘খাড়া শো’ আর ‘টিজে’ মডেলের ট্রাকগুলো ‘সিভিল শো’ ট্রাক হিসেবে দেশে পরিচিত। ‘টিজে’ মডেলের ট্রাকের ইঞ্জিন সামনের দিকে থাকে, আর ‘টিকে’র ইঞ্জিন কেবিনের নিচে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা পর্যায়ে জড়িয়ে রয়েছে এই ট্রাক। ১৯৭১ সালে এই ট্রাক ব্যবহার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। মালামাল পরিবহন থেকে শুরু করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন বাহিনীতে এই ট্রাকের বহুল ব্যবহার ছিল।
২০০৪ সালে ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল দুটো বেডফোর্ড ট্রাকের ওপর। আবার ২০১৫ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসার সামনে যে ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে রাস্তা আটকানো হয়েছিল, সেখানেও ছিল বেডফোর্ড ট্রাক।
অশীতিপর মোটর মেকানিক মফিজুর রহমানের জীবনের বেশির ভাগই কেটেছে বেডফোর্ডের সঙ্গে। পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে তিনি যখন পুরান ঢাকার বনগ্রাম রোডের ‘সাত্তার মহাজনের’ সিটি গ্যারেজে মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, তখন সবে কিশোর তিনি।
মফিজুর জানালেন, তখন বেশিরভাগ গাড়িই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি শেভ্রলে কিংবা ডজ। তখন ডেমরা রোডে (ডেমরা টু টিকাটুলি) চলত বিখ্যাত ‘মোমিন কোম্পানির’ মুড়ির টিন বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত শেভ্রলে ট্রাকের ওপর কাঠের বডি বানিয়ে বাস হিসেবে চালানো হত। এগুলোকে বলা হত ‘ফর্টি টু’ মডেল।
তবে ওই গাড়ি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হত প্রায়ই, ইঞ্জিনের হেড অচল (ক্র্যাক) হয়ে যেত। ষাটের দশকের শুরু থেকে ঢাকায় বেডফোর্ড আসা শুরু হল। ইংল্যান্ডের বেডফোর্ড ঘোষণা দিল, তাদের ইঞ্জিনের হেড ‘ক্র্যাক’ করবে না।
রোটারি ডিজেল পাম্প ব্যবহারের কারণে বেডফোর্ডের ইঞ্জিনগুলো সে সময় সবচেয়ে শক্তিশালী আর টেকসই বলে বিবেচিত হয়। মোমিন কোম্পানিও তাদের অনেকগুলো ‘ফর্টি টু’ মডেলে বেডফোর্ড ডিজেল ইঞ্জিন বসিয়ে নেয়।
শুরুর দিকে পেট্রোল ও ডিজেল দুই রকম ইঞ্জিনের ট্রাকই আসত। ছয় সিলিন্ডারের পেট্রোল ইঞ্জিনগুলো ছিল ফোরস্ট্রোকের। আর ডিজেল ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হত রোটারি পাম্প, যার কারণে এর শক্তিও বেশি। তবে জ্বালানি খরচ হাল আমলের যে কোনো গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি।
ইঞ্জিন মেকানিক মফিজুর ষাটের দশকের শুরুতে বনগ্রাম রোডের গ্যারেজ পাল্টে র্যানকিন স্ট্রিটের ‘আসলাম মোটরসে’ যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জের মেরিন ডিজেল ইনস্টিটিউট থেকে ছয় মাসের ডিজেল ইঞ্জিনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বেডফোর্ড ট্রাকের ইঞ্জিনের কাজ শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশারের (বীর উত্তম) হাত ধরে ৬ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীয় ওয়ার্কশপের ‘হেড মেকানিক’ হিসেবে যুক্ত হন মফিজুর। যদিও তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।
মফিজুর জানান, ৬ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার লালমনিরহাটের বুড়িমারী রেল স্টেশনের কাছেই ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেওয়ার জন্য সেখানে ৩০টির মত যানবাহন ছিল। এর মধ্যে ১৫টি ছিল বেডফোর্ড ট্রাক। স্থানীয় ঠিকাদার আর সুগার মিল থেকে এই ট্রাকগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এসব গাড়ির জ্বালানি তেল আর যন্ত্রাংশ আসত জলপাইগুড়ি থেকে। এই গাড়িগুলো দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেওয়া করা হত। আর সেক্টর কমান্ডার চড়তেন একটি পুরনো উইলিস গাড়িতে।
মফিজুর স্মৃতি হাতড়ে বললেন, সেই ষাটের দশক থেকে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটল বেডফোর্ডের সঙ্গে।
“এরপর দেশে কত গাড়ি এলো-গেল, কিন্তু বেডফোর্ডটা টিকেই রয়েছে টেকসই চেসিস আর শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে। যদিও এখন তেলের দামের কারণে সারা দেশে বেডফোর্ডের বাণিজ্যিক ব্যবহার কমে গেছে। তবে ঢাকা শহরে গ্যাস (সিএনজি) দিয়ে চালাতে পারে বলে বেডফোর্ডগুলোকে এখনো রাস্তায় দৌড়ে বেড়াতে দেখা যায়।”
বেডফোর্ডের আয়ু শেষ হবে কবে
ট্রাক চালক হাফিজুর ‘গাজীপুর-ন’ নম্বরপ্লেটের একটি বেডফোর্ড ট্রাক চালান। কথায় কথায় তিনি বলেন, গাড়িটি কত পুরনো- তার কোনো হিসাব তার কাছে বা মালিকের কাছে নেই। নম্বর একটা নামকাওয়াস্তে ঝুলিয়ে রেখেছেন। প্রতিমাসে পুলিশকে দেড় হাজার টাকা ‘মান্থলি’ দিয়ে গাড়ি চলছে।
হাফিজুরের ভাষ্য, রোটারি পাম্পের কারণে এই গাড়ির ইঞ্জিনের শক্তি যেমন বেশি, তেমনই জ্বালানি খরচও বেশি। এই গাড়ি টিকে রয়েছে এখন সিএনজিতে চালানো যায় বলে। দুই হাজার টাকার সিএনজি নিলেই মোটামুটি সারারাত চালানো যায়। এক রাতে গড়ে ছয় হাজার টাকা ‘ক্যাশ’ হয়।
সেই টাকার বাটোয়ারার প্রশ্নে তিনি জানালেন, এখান থেকে চালক পান এক হাজার টাকা, তিনজন শ্রমিকের মজুরি দেড় হাজার, গ্যাসের খরচ দুই হাজার টাকা। বাকিটা মালিকের থাকে। অনেক পুরনো হলেও এসব গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হালের অন্যান্য গাড়ির তুলনায় কম।
মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ করলেই সারা মাস ভালোভাবে চালানো যায়। এই ট্রাকের ফুয়েল পাম্প থেকে শুরু করে ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি ঢাকায় এখনও পাওয়া যায়।
কোনো পার্টস গাবতলী-আমিনবাজারে না পেলে ধোলাইখাল আছে, সেখানে ‘বেডফোর্ড মার্কেট’ নামে একটি আলাদা বাজারই আছে। একসময় ধোলাইখালের এই মার্কেটে কেবল বেডফোর্ডের মালামালই পাওয়া যেত। এখন অন্য গাড়ির মালামালও পাওয়া যায়।
ঢাকার বছিলা এলাকার আবুল কাশেমের বেশ কয়েকটি ট্রাক রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি বেডফোর্ডের। তার কথায় অবশ্য নানা সংকটের কথা উঠে এল।
“বেডফোর্ড ট্রাকগুলোর স্টিয়ারিং হুইল ম্যানুয়াল, অর্থাৎ অলিগলিতে লোড গাড়ি ঘোরাতে চালককে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। একরাত ভালোভাবে গাড়ি চালালে পরদিন কাঁধের ব্যাথায় কাজে আসতে চান না অনেক চালক। তাছাড়া গাড়িগুলো সিএনজিতে চলায় এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ চললে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়।
“এ কারণে ভরা ব্যবসার মৌসুমে গাড়িগুলো ব্যবহার করা যায় না। তাছাড়া এখন কন্সট্রাকশন সাইটগুলোতে বালু, পাথর এসব মালামালের ক্ষেত্রে মালিকেরা ডাম্প ট্রাক চান, কারণ ওসব মাল আনলোড করতে সময় লাগে কম। কেবল ইট পরিবহনে বেডফোর্ড ট্রাকগুলোর প্রয়োজনীয়তা এখনও রয়ে গেছে।”
নানা কারণে এখন অনেকেই বেডফোর্ড কেটে ফেলছেন বলে জানান ট্রাক মালিক আবুল কাশেম।
সম্প্রতি বছিলায় একটি বেডফোর্ড ট্রাক কেটে পিকাপে ভরে নিয়ে যেতে দেখা যায়। ঠিকাদার নাসিরউদ্দীন জানালেন, এখন ভাঙারি লোহার দাম অনেক বেশি, ৫৫ থেকে ৬০ টাকাও পাওয়া যায়। এছাড়া বেডফোর্ডের বডিসহ অনেক পার্টস কিনে নেন রিকন্ডিশন্ড পার্টস ব্যবসায়ীরা।
“সব মিলিয়ে একটা বেডফোর্ড কেটে বেচলেও কম না। এ যেন মরা হাতি, মরলেও লাখ টাকা,” বলেন কাশেম।
ট্রাক চালক মোসলেমউদ্দীন বলছেন, ইটের ভাটার রাস্তাগুলো সারা বছরই কাদা দিয়ে ভরা থাকে। অন্য গাড়িগুলো ওই রাস্তায় লোড নিয়ে টানতে গেলে এক্সেল পর্যন্ত ভেঙে যায়। এসব রাস্তায় বেডফোর্ড ডালাভর্তি মাল নিয়ে ‘চ্যালচ্যালায়া দৌড়ায়’।
১৪ ফুট দৈর্ঘ্যে আর ছয় ফুট প্রস্থের বডি (মাল রাখার জায়গা) নিয়ে বেডফোর্ড ঢাকার অলি-গলিতেও অনায়াসে ঢুকে যায় বলে জানান তিনি।
আরেক চালক নুরুল ইসলামের ভাষ্য, বেডফোর্ডের সবই ভালো, কিন্তু এই ট্রাক এখন সিএনজি নির্ভর হওয়ায় মহাসড়কে লম্বা দূরত্বে চালানো যায় না। বেডফোর্ড ট্রাক নিয়ে মেঘনা বা বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে গেলে পুলিশও ঝামেলা করে।
তবে সিএনজিতে রূপান্তরিত বেডফোর্ডের চেয়ে কম টাকায় আর কোনো গাড়ি মাল পরিবহন করতে পারবে না বলে দাবি নুরুলের।
“সরকার মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা করছে। এই নীতিমালার আওতায় ২০ বছরের পুরনো বাস ও ২৫ বছরের পুরনো ট্রাক স্ক্র্যাপ করে ফেলতে হবে। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে তখন বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গত ২১ মে একই মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত খসড়া ‘মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা’-তে বলা হচ্ছে, ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত মোটরযান সরকার নির্ধারিত ভেন্ডরের মাধ্যমে স্ক্র্যাপ করে ফেলতে হবে। এর বাত্যয় হলে মালিকেরা শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
সুত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম